ছুটি

শ্রাবণ মাসের ঝুম বৃষ্টি, জহির গার্ড রুমের ভিতর বসে আছে। হঠাৎই তার স্ত্রী পারুলের ফোন আসলো, জানালো আরিফের প্রচণ্ড জ্বর, সে নাকি খুব করে চাচ্ছে বাবা তার পাশে এখন একটু থাকুক, বাবা আসলেই নাকি সে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে। আরিফ ক্লাস ফাইভে পড়ে, জন্মের পর সব কিছু ঠিক ঠাক বুঝার পর থেকেই জহির বাসা থেকে অনেক দূরে দূরে চাকরি করে, বাবাকে তেমন কাছেই পাওয়া হয়নি তার। বাবা ছেলের একসাথে থাকতে না পারার যন্ত্রণাটা আরিফের যত বেশি জহিরের তার চাইতে আরও অনেক অনেক বেশি, কারণ আরিফের কষ্টের দিক শুধু একটা: বাবাকে কাছে না পাওয়া, কিন্তু জহিরের কষ্টটা বহুমুখী, যেমন: ভালোবাসার মানুষের সাথে না থাকতে পারার কষ্ট, বাবার দায়িত্ব ঠিকঠাক ভাবে পালন করতে না পারার কষ্ট, আরিফ যে কষ্ট পাচ্ছে বাবাকে পাশে না পেয়ে সেটা ভাবার কষ্ট আর হয়তোবা আরও ভিন্ন ভিন্ন মাত্রার কিছু কষ্ট। আরিফ আর তার মা নানামুখী কষ্টের কথা ফোন করে জহিরকে বলতে পারে কিন্তু জহির তার জীবনের কষ্টগুলোর কোনটাই পারুল বা আরিফকে বলেনা। জহির ভাবে যে “ওদের তো এমনিতেই সুখ দিতে পারলাম না, আবার নিজের দুঃখ আর টেনশনের কথা বলে তাদের দুঃখ বাড়াতে যাবো কেনো?

 

বৃষ্টি আরও বেড়েছে, মেঘও অনেক ঘন আর কালো হচ্ছে। জহিরের মনে হচ্ছে এই অবস্থায় ছুটি নিয়ে বাড়ি যাওয়া তার জন্য ঐ ঘন কালো পুরু মেঘের আস্তরণ ভেদ করে দ্বিতীয় আসমানে চলে যাবার চেয়েও কঠিন কাজ। কারখানার খুব খারাপ সময় যাচ্ছে, এই অবস্থায় মালিক কোন ভাবেই ছুটি দিবেনা। কারখানার মালিক আহসান খুব ভালো মানুষ, কিন্তু ইদানীং ব্যবসা খুবই খারাপ যাচ্ছে, অনেক কষ্টে তিনি সব কর্মচারীদের বেতন দিয়ে কারখানাটা চালান, কিন্তু গত দুই মাসের বেতন এখনও দিতে পারেননি। জহিরের হাত একদমই খালি, কুষ্টিয়াতে যাবার জন্য আসা যাওয়ার খরচও তার কাছে এখন নেই।

 

কারখানার ভেতরে ছোট্ট একটা রুমে জহির আর এই কারখানার আরেকজন সিকিউরিটি গার্ড মামুন দুজন একসাথে থাকে আর কারখানার পাশের একটা দোকান থেকে বাকীতে বাজার সদাই নিয়ে রান্না করে খায়। মামুনের জীবনের দুঃখগুলো জহিরের সাথে অনেকটাই মিলে যায়, দুঃখ ভরা এই জীবনে কষ্ট শেয়ার করার মতো একজন বন্ধু পাওয়াটাই এই কারখানার চাকরির জীবনে তার সবচেয়ে বড় পাওয়া। ওরা দুইজন কারখানার গেইটে বারো ঘণ্টা করে সিকিউরিটির শিফটিং ডিউটি করে, তবে মামুন তার ডিউটি না থাকলেও জহিরের ডিউটির সময় গার্ডরুমের পাশে সুখ দুঃখের গল্প করার জন্য বসে থাকে। মামুনের এই সঙ্গ জহিরের হাজারো কষ্টে ভরা জীবনে কিছুটা হলেও প্রশান্তি দেয়, কিন্তু মামুন যখন ছুটি নিয়ে বাড়িতে যায় তখন জহিরের মনে হয় যে গভীর অন্ধকার বিচ্ছিন্ন একটা আলাদা গ্রহে সে বাস করছে, সেই গ্রহে শুধুই অন্ধকার আর একাকীত্ব।

রাত বারোটার পর মামুন ডিউটি করা শুরু করলে জহির তখন ঘুমাতে গেলো। বিছানায় শুয়ে সে আরিফ আর পারুলের কথা ভাবছে। বাইরে তখনো প্রবল বৃষ্টি, ঝরো বাতাস আর মেঘের ডাক। মেঘের ডাকগুলো তার বুকের উপর একটা করে কম্পন বইয়ে দিয়ে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে তার ভাগ্য আর অপারগতা নিয়ে মেঘেরাও উপহাস করছে, বাতাসের শো শো শব্দ পারুলের হয়ে আক্ষেপ ঝাড়ছে তার উপর। ধীরে ধীরে ঘুম গ্রাস করলো জহিরের শরীরকে। এরপর এই ঘুমের স্বপ্নটা জহিরের মনটাকে ঝরো হাওয়ার মতো উড়িয়ে নিয়ে গেলো কুষ্টিয়াতে।

জহির ঘরের দরজার কড়া নাড়লো। পারুল দরজা খুললো, আরিফ শুয়ে আছে বিছানায়। আরিফ বললো:

‘বাবা তুমি আসছো?

‘হ্যাঁ বাবা, তোমার নাকি জ্বর?

‘তুমি আসছো, এখন ভালো হয়্যা যাবো বাবা

বিছানা থেকে আরিফ উঠে বসলো। পারুল, আরিফ আর জহির একসাথে বসে রাতের খাবার খেলো। ঘন ডাল আর বেগুন ভাজি করেছে পারুল, খাবার জুড়ে পারুলের ভালোবাসার সুঘ্রাণ। অনেকদিন এমন শান্তি নিয়ে খায়নি জহির।

খাওয়ার পর আরিফ বললো: ‘বাবা তুমি আমারে জড়ায়ে ধইরে ঘুমাও, তাইলে আমি ভালো হয়্যা যাবো’

জহির আরিফকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়লো, ঘুম পাড়ানোর জন্য আরিফের চুলে হাত বুলাচ্ছিলো। আরিফ বাবাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লো। জহিরের শরীরটাও ঘুমে অবশ হয়ে আসছে। একটা প্রশান্তির ঘুম তার শরীর-মনকে অন্ধকার রাতের নিস্তব্ধতার সাথে মিশিয়ে দিলো।

ঘুমের স্বপ্নের বাহনে কুষ্টিয়ায় পারুল আর আরিফের কাছ থেকে ঘুরে আসার পর জহিরের ঘুম ভাঙলো যথারীতি কারখানার ছোট্ট ঘরের বিছানাতেই। এভাবে ঘুমের মধ্যে অনেকবারই তার কুষ্টিয়া যাওয়া হয়েছে। স্বপ্নে কিছু সময়ের জন্য হলেও ভালোবাসার মানুষদের সান্নিধ্য পাওয়ার পর যখন আবার সে ঘুম থেকে জেগে উঠে তখনকার অনুভূতিটা কি সুখের নাকি দুঃখের ঠিক বুঝে উঠতে পারেনা জহির। সশরীরে যাবার সামর্থ তো নেই তাই স্বপ্নে হলেও তাদের দেখা পায়, এর অনুভূতি হয়তো সুখেরও হতে পারতো, কিন্তু ঘুম ভাঙার পরই যে বিচ্ছেদের দেয়াল তৈরি হয় সেই দেয়ালটা অনেক নিষ্ঠুর, অনেক উঁচু, পুরু আর শক্ত, একটু উঁকি দিয়ে ফিরে তাকানোরও জো নেই। ঘুমের ঘোর কাটার পরও এই দেয়ালটা তার জীবন আর ভালোবাসার মাঝে একটা দানবীয় বাধা হয়ে চোখ রাঙিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে।

বেলা দশটা থেকে গেইটে জহিরের ডিউটি আবার শুরু হলো। বৃষ্টি থামলেও আকাশ একদম মেঘলা, খুব ঠাণ্ডা হিমেল একটা বাতাসের প্রবাহ। সারা রাত ডিউটি করার পর মামুন এই দিনের বেলায় ঘুমাতে না গিয়ে জহির আর তার জন্য দুই কাপ চা নিয়ে আসলো । প্রতিদিন মামুন এই সময়ে ঘুমাতে যায়, আজ কেন চা নিয়ে গার্ড রুমের সামনে আসলো জহির বুঝলো না।

‘জহির ভাই, কী হইসে? এতো মনমরা হইয়া আছেন ক্যান?’

‘না ভাই, এম্নে... কিছুনা, তুমি ঘুমাইতে যাওনা ক্যান’

‘বাতাসটা খুব সুন্দর, ঘরের ভিতরে বাতাস যায়না, উল্টা গরম লাগে, তাই ভাবলাম না ঘুমাইয়া আপনার সাথে চা খাইতে খাইতে একটু গপ সপ করলে আরও বেশি ভালো লাগবো’

‘তো বাসার সবাই ভালো?’

‘হ ভাই, ভালো, আপনি এতো মন কালো কইরা বইসা আছেন ক্যান সেইটা বলেন’

‘ছেলেটার শরীর ভালো না, তোমার ভাবী ফোন করছিলো, বাসায় যাইতে বললো’

‘তাইলে আপ্নে যান, আমি আছি এখানে, আমি একা পুরা ডিউটি দিবোনে’

বাড়িতে যাবার মতো টাকা হাতে নেই এই কথাটা জহির বললো না, কারণ ও জানে যে এটা বললে মামুন যে কোন জায়গা থেকে অনেক কষ্ট করে হলেও টাকা যোগাড় করে এনে দিবে। মামুন অন্যরকম ভাল একজন মানুষ, মানুষটার ভালোবাসার কাছে ও ঋণী, এই ঋণ আর বাড়াতে চায়না সে।

কারখানার গেইটের পাশেই ডাকাতিয়া নদী। নদীটা কিছুদূর গিয়েই মেঘনার সাথে গিয়ে মিলেছে, আর মেঘনা দক্ষিণে গিয়ে মিলেছে সাগরে। শান্ত এই নদীটায় আজকে বেশ স্রোত। গেইটের সামনে বসে জহির তাকিয়ে আছে নদীর দিকে। জোয়ার চলছে এখন, খরস্রোতে কচুরিপানাগুলো মেঘনা থেকে এই পূর্ব দিকে ভেসে আসছে। যেসব নৌকা পূর্বে যাচ্ছে সেগুলো স্রোতের টানে এমনিতেই চলছে, ইঞ্জিনও চালাতে হচ্ছেনা, মাঝিকে বৈঠাও চালাতে হচ্ছেনা, আর যে নৌকাগুলো পশ্চিমে মেঘনার দিকে যাচ্ছে স্রোত তাদের একদমই আটকে দিচ্ছে, পিপড়ার মতো ধীর পায়ে অনেক কষ্টে আগাচ্ছে ওরা। জহির ভাবছে: ওদের পথ যেন ঠিক তার বাড়ি ফেরার পথের মতোই বাধায় ভরা।

এই কারখানার চাকরিতে জহিরের জীবন এভাবে চললো আরও পাঁচ বছর, এর মধ্যে বাড়িতে যাওয়া হয়েছে তার প্রায় তিন মাস পর পর, একবার বাড়িতে গেলে পারুল আর আরিফের সাথে সময় দেয়া হয়েছে দুই-তিন দিন কারণ ছুটি তো আর বেশিদিন মিলে না। এতদিন পর পর গিয়ে মাত্র দুই-তিনদিন তাদের সাথে সময় কাটানো সুখ যা দেয় চার চেয়ে আক্ষেপ বাড়ায় বেশি। গ্রীষ্মের প্রবল খরায় ক্ষেতের শুষ্ক চির ধরা মাটিতে এক গ্লাস পানি ফললে তা যেমন নিমিষেই শুকিয়ে মিলিয়ে যায় বাতাসে, জহিরের বাড়িতে থাকা এই দুই-তিনদিন সময় যেন ঠিক এমনি ভাবে ফুরিয়ে যায়।

গত বছর থেকেই কারখানার ব্যবসা খুব খারাপ যাচ্ছে, অনেকদিনই প্রোডাকশন বন্ধ রাখতে হচ্ছে। আজ কারখানার মালিক আহসান জহিরকে ডেকে খুব অমায়িক ভাবে বললেন ‘জহির, ব্যবসা খারাপ যাচ্ছে, এতো মানুষের বেতন দিয়ে কুলাতে পারছিনা, আপনি কিছুদিন বাড়িতে রেস্ট নেন। খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে আবার ডাকবো’। আহসান চাচ্ছে যে গেইটের ডিউটি মামুন একাই করুক আর মাঝে মাঝে কারখানার অন্যান্য কর্মচারীদের কেউ কেউ গেইটে ডিউটি করবে, দুইজন সিকিউরিটি গার্ড এই মুহূর্তে সে চালাতে পারবে না।

জীবনের অনেকটা সময় পর জহিরের একটা লম্বা ছুটি হলো। জহির জানে যে এই “ছুটি” আসলে ঠিক ছুটি না, ওর চাকরিটা আসলে গেছে, ‘খুব তাড়াতাড়ি আপনাকে আবার ডাকবো’ আহসানের এই কথাটা হয়তোবা নেহাৎ একটা ভদ্রতার খাতিরে বলা।

আজ বিকেলে জহির কুষ্টিয়ার বাসে উঠবে। মামুন তাকে এগিয়ে দিতে বাস স্ট্যান্ডে এসেছে।

‘জহির ভাই, আপ্নে চইলা যাওয়া মানে, মাথার উপরের ছায়াটা চইলা যাওয়া, আপ্নারে আবারে ফিরা আসতে হইবো, মালিক তো বলছে যে ব্যবসা একটু ভালো হইলেই আপনারে আবার নিয়া আসবে’

‘হুম’

জহির এটা জানে যে মামুনের সরল বিশ্বাস আর এই পৃথিবীর বাস্তবতা দুটো দুই জিনিস, আবেগ দিয়ে তো আর ব্যবসা হয়না, কারখানার ব্যবসার অবস্থা আসলেই খারাপ।

এই অনাকাঙ্ক্ষিত “ছুটি”কে পারুল ভালোভাবে নেয়নি, সে যানে যে শুধু ভালোবাসা দিয়ে সংসার হয়না। ক্লাস টেনে পড়া আরিফও এটা বুঝতে পারছে যে বাবার এমন দীর্ঘ “ছুটি”তে আসা সংসারের জন্য খুব একটা ভালো কিছু বয়ে আনবে না, স্কুলের বেতনটাও দেয়া খুব কঠিন হয়ে যাবে। ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসা জহিরের কাছে যেখানে অধরা স্বপ্নের মতো ছিলো, সেই “ছুটি”কে তার ভালোবাসার মানুষেরাও ভালোভাবে নিচ্ছেনা।

দুই মাস যাবার পর জহির মুটামুটি নিশ্চিত হলো যে জহিরের আর কারখানার সিকিউরিটি গার্ডের চাকরিতে ফিরে যাওয়া হবেনা, মামুন জানিয়েছে যে এই মাসে আরও অনেক কর্মী ছাটাই করা হয়েছে। সংসারটা কোন মতো টিকিয়ে রাখার জন্য রাজশাহীতে তার একজন আত্মীয়ের আম বাগানে চাকরি নিলো, এখানে তার দায়িত্ব গাছের যত্ন নেয়া আর আম ধরার মৌসুমে গাছ থেকে আম সংগ্রহে সাহায্য করা।

আম বাগানে প্রায় দেড় বছর চাকরি করার পর জহিরকে আবারও বাড়ি ফিরতে হলো। বাগানে সারাদিনের টানা পরিশ্রমটা তার শরীরে ঠিক সইলো না, বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লো সে। বাড়ি ফেরার মাস খানেকের মধ্যে জহিরের একটা পা প্যারালাইজড হয়ে গেলো, এ যেন না চাইতেই একদম এক আমৃত্যু ছুটিকে বরণ করে নেয়া। এমন করে ছুটি পাওয়া আসলে সেদিন ঝরের রাতে ঘুমে স্বপ্নের বাহনে চড়ে বাড়ি এসে সন্তানকে জড়িয়ে ধরা আর স্ত্রীর হাসি ভরা মুখের চাহুনি দেখার মতো সুখ দেয়না। এ “ছুটি” শুধু নিজেকে একটা উচ্ছিষ্ট বস্তু জ্ঞান করার অনুভূতি দেয়। এতো বড় একটা ছুটি, কিন্তু এ ছুটির সময়কালের একটা রাতেও আরফিকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানোর সুখানুভূতি সে পাবেনা।

আরিফ সিএনজি চালানো শিখেছে, কুষ্টিয়া শহরে সে এখন সিএনজি চালায়, গ্রামে মায়ের কাছে মোবাইলে টাকা পাঠায়। পারুল সে টাকা দোকান থেকে তুলে সংসারের খাওয়ার খরচ চালায়। সংসারে জহিরের এখন কোন রকম ভূমিকা নেই। আরিফ আর পারুলের কাছে সে করুণা হয়তো পায়, কিন্তু ভালোবাসা না। জহির ঘরে ফিরতে চেয়েছিলো, কিন্তু যে বাড়িতে ভালোবাসা নেই তাকে তো বলা যায় শুধু বাসস্থান। ভালোবাসা যেখানে নেই তাকে কি ঘর বলা যায়?

 

 

Comments

Popular posts from this blog

হ্যান্ডরাইটিং, ক্যালিগ্রাফি, লেটারিং, টাইপোগ্রাফি ও টাইপফেইস ডিজাইন

দেয়াল