পাশের বাসার তুলি প্রচণ্ড ভালোবাসে সাকিবকে। আজ থেকে দুই বছর আগে, নিউ মার্কেট এ হঠাৎ সাকিব এর হাত ধরে তুলি বলেছিলো: ‘আমি আপনার সাথে সারা জীবন থাকতে চাই’। তুলির এ অপ্রত্যাশিত আচরণের উত্তরে সাকিব কিছুই বলেনি, শুধু হেসেছে। তুলি খুব স্পষ্টভাবেই বুঝেছিলো যে সেটা ছিল একটা তাচ্ছিল্যের হাসি

ভালবাসা প্রত্যাখ্যাত হবার জন্য তুলির যে সকল অপরাধ ছিল তা হলো: তুলি সাকিব এর চেয়ে মাত্র দুই বছর এর ছোট, কিন্তু সাকিব এর কাছে বিয়ের জন্য স্ট্যান্ডার্ড এইজ গ্যাপ হলো প্রায় আট থেকে দশ বছর। দেখতে খারাপ না, কিন্তু আবার সাকিবের যেমন দুধে আলতা গায়ের রঙ এর মিষ্টি মেয়ে পছন্দ, তেমনটি না। সাকিব ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করা একজন সুদর্শন যুবক, তাই বিয়ের ব্যপারে তার আশা এমন যে কোন ধনী বাবার সুন্দরী মেয়েকে তার হাতে তুলে দেয়া হবে। ঘরে শুধু সুন্দরী বৌ থাকলেই তো আর হয়না, ফাইনানশিয়াল সিকিউরিটিও দরকার আছে। তুলিরা যে বাসায় ভাড়া থাকে তা সাকিবের বাসার ঠিক পাশেই, দুই বাসার বারান্দা প্রায় একসাথে লাগানো।  তুলিদের বাসা সাকিবের বাসার চাইতে অনেক ছোট আর অনেক কম ভাড়ার সাধারণ একটা বাসা। তাই তুলির ভালবাসা ,ঘন ঘন ফোন আর দেখা করতে চাওয়াকে সাকিব এখন ডিস্টার্ব হিসেবেই দেখে।

একবার এক পহেলা বৈশাখীর আগেরদিন সন্ধ্যায় তুলি সাকিবকে ফোন করে নিউ মার্কেট এ আসতে বলে, সাকিব তাই  ভাবছিল যে: ‘আবার কোন ঝামেলায় পড়ি কে জানে’, তারপরও সে গেলো। তুলি সাকিবকে বললো, ‘আপনাকে একটা বৈশাখী শার্ট গিফ্‌ট করব, এটা পরে কাল আপনি আমার সাথে ঘুরবেন। সাকিব খুব আপত্তি জানালে তুলি খুব সিরিয়াসলি বললো, ‘শোনেন, কালই আপনাকে আমি লাস্ট ডিস্টার্ব করব, কাল ঘুরে আসার পর আপনাকে আর কোনদিনও ফোনও দিবোনা, কোনদিন দেখাও করতে বলবোনা, শুধু আমার লাস্ট ইচ্ছাটুকু রাখেন’। সাকিব খুশিই হল। বললো, ‘ওকে, তাহলে বিকেলের পর, তার আগে আমার অনেক কাজ আছে’। তুলি রাজি হল। যাবার আগে তুলি সাকিবের হাতে ছোট একটা কাগজ দিয়ে বললো, ‘এটা বাসায় গিয়ে পড়বেন’।

বাসায় গিয়ে সাকিব কাগজটা খুললো, এতে লেখা আছে:

‘এই আলো আলো বিকেলে

শুধু বসো এসে পাশে,

আমি চাইবোনা ভালোবাসা-প্রেম,

চাইবোনা বদলে যাও

আমার প্রেমের আবেশে।’

পরদিন সকালে পহেলা বৈশাখীতে তুলির দেয়া শার্ট পরে সাকিব সারাদিন টিএসসিতে তার বন্ধু মারুফকে নিয়ে ঘুরলো আর ঢাকা ইউনিভার্সিটির ফার্স্ট ইয়ারের নতুন মেয়েদের সাথে দেখা করলো, কথা বললো। সাকিব এর সাদা চামড়ার সাথে তুলির দেয়া সাদা শার্টটা খুব মানিয়েছিলো, আর সাথে ইঞ্জিনিয়ার তকমাটা তো আছেই, তাই ঐ মেয়েদের সাড়াও খারাপ ছিলোনা। বন্ধু মারুফ যার সাথেই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল সবাই খুব আহ্লাদী ভাবে তাকে ভাইয়া ভাইয়া বলে ডাকছিল, বেশ ভালই লাগছিল সাকিবের। ঈশিতা নামের একজন এর সাথে পরিচয় হবার পর তার ফেইসবুক আইডিও নিয়ে নিলো আর মোবাইলেই তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে দিল। সব মিলিয়ে এতো গরমের মধ্যে কষ্ট করে ঘুরাঘুরিটা বেশ সার্থকই হলো বলতে হবে।

সাকিব বাসায় ফিরলো বিকেল চারটায়, ভীষণ টায়ার্ড, তাই জামা-কাপড় পাল্টেই, মোবাইলটা সাইলেন্ট করে ধাপ করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। পাঁচটার দিকে সাকিবের বোন তানিয়া গায়ে ধাক্কা দিয়ে ঘুম ভাঙিয়ে দিয়ে বললো, ‘কিরে ভাইয়া, কিছু খেলিনা তো দুপুরে, খাবি না?’। ঘুম থেকে উঠেই সাকিব দেখলো মোবাইলে সাতটা মিস্‌ড কল। সাকিব ফ্রেশ হয়ে তুলিকে ফোন করলো, পনের মিনিট পর বাসা থেকে বের হতে বললো।

রিকশায় ওরা দুজন উঠলো বাসার সামনের মোড় থেকেই। সূর্য আজকের মত ডুবে যাবার তালে আছে। তুলির ইচ্ছে ছিলো যে অন্তত বিকেলের স্নিগ্ধ আলোতে দুজন কিছুক্ষণ ঘুরতে পারবে। যাই হোক, এই গোধূলির আলোতে, অভিমান আর চাঁপা আশা নিয়ে তুলি সাকিবের পাশে বসে আছে, রিকশার গন্তব্য ধানমন্ডি লেক।

রিকশা কিছুদূর আগাতেই দুজনই অনুধাবন করল যে আজ মারাত্মক একটা ট্রাফিক জ্যাম অপেক্ষা করছে তাদের জন্য। ওদের রিকশা আর আশে পাশের সব যানবাহন পিপড়ার মত আগাচ্ছে, আর সাথে বৈশাখের প্রচণ্ড গরম তো আছেই। শেষবারের মত হলেও সাকিবের সাথে সুন্দর কিছু সময় কাটানোর সেই ইচ্ছেটা যেন অনেকটা মশকরা করছে তুলির সাথে। দুজনের শরীরই ঘামছে ভীষণ, সাকিবের চোখে মুখে প্রচণ্ড বিরক্তির ছাপ। তুলি আছে বিভিন্ন রকমের অনুভূতি মাখা একটা প্রবল ঘোরের মধ্যে, ওর অবচেতন মন এখন ভাবছে যে, যদি সাকিব ওর হাত ধরে বলতো: ‘এত জ্যাম, রিকশার চেয়ে বরং হাঁটাই ভালো’ তাহলে হয়তো সে সারা জীবন মানুষটার হাত ধরে মাইলের পর মাইল হাঁটতে পারতো, একটুও ক্লান্তি লাগতোনা। তুলির ঘোর ভাঙলো জ্যাম ছাড়ার পর সব রিকশার বেলের টুং টুং শব্দ, গাড়ীর হর্ন আর হুড়োহুড়ি করে ছুটার শব্দে।

ধানমন্ডি লেকে পৌছাতে ওদের সময় লাগলো দেড় ঘণ্টা। সেখানেও কোন রোমান্টিক পরিবেশ নেই, খালি মানুষ আর মানুষ, মানুষের শরীরের তাপেই মনে হয় এলাকার তাপমাত্রা প্রায় পাঁচ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেড়ে গেছে। তুলি চেয়েছিল যে পার্কের বেঞ্চে সাকিবের সাথে কিছুক্ষণ নিরিবিলি বসে থাকবে কিন্তু এমন আবহাওয়াতে এখন এখানকার অভিজাত রেস্টুরেন্টগুলোই একমাত্র সম্বল কিছুটা নিরিবিলি সময় কাটানোর জন্য।

ভাবতে না ভাবতেই আকাশে মেঘের গর্জন, আর শুরু হয়েছে ঝরো বাতাস, বোঝা যাচ্ছে পুরোপুরি কালবৈশাখী ঝর শুরু হবে কিছুক্ষণের মধ্যে। তুলি এখনো আছে ঘোরের মধ্যে, ভাবছে: আজ বুঝি দুজনের কাকের মতো ভেজা হবে, বৃষ্টি সাকিবকে ধুয়ে মুছে করে দিবে একদম নতুন সুন্দর এক সাকিব, যার কঠোরতার খোলস ভেঙ্গে বের হবে প্রেমময়ী একটা মন।

হঠাৎই সাকিব চিৎকার করে পাশের রিকশা ওয়ালাকে ডেকে বললো,  ‘এই মামা যাবা এলিফ্যান্ট রোড?’ আর তাতেই আবারো ঘোর ভাঙলো তুলির, সাকিব বাসায় যাবার জন্য উদ্যত হয়েছে। ‘তাড়াতাড়ি উঠো, বৃষ্টি আসতেছে’, তুলি বোকার মত তাকিয়ে আছে সাকিবের চেহারার দিকে।

বৃষ্টি পুরোপুরি শুরু হলো যখন ওরা দুজন বাসায় পৌঁছালো, একদম কালবৈশাখী। তুলি ওর বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। এই বারান্দাটাই সাকিবের বারান্দার মুখোমুখি। তুলি ভাবছে: সাকিবের দখিনা জানালাটা হয়তো খোলা আছে, এই ঠাণ্ডা বাতাস কিছুটা হলেও ওর গায়ে লাগছে, ও হয়তো বৃষ্টি দেখছে। এই ঝরের ঠাণ্ডা বাতাসের টানে হলেও ও হয়তো বারান্দায় আসবে, মানুষটাকে দেখা যাবে এই আবছা আলোয়। সাকিবকে ফোন করতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু তা তো আর করা যাবেনা, তাই সে মোবাইলে একটা মেসেজ পাঠালো:

‘তোমার বারান্দায় ভেজা হিম বাতাস

আর কাঁঠালচাঁপার ঘ্রাণ,

একটু এসে দাঁড়াও শুধু

শুনাবো মেঘলা দিনের গান।’

কিন্তু ঝর আসুক কি বৃষ্টি আসুক, তাতে সাকিবের কিছু যায় আসেনা। মনের জানালার মতোই তার দখিনা জানালাটাও সে খুব একটা খুলেনা। মোবাইলের মেসেজ তার চেক করা হয়নি। ফ্রেশ হয়েই সাকিব ল্যাপটপ খুলে ফেইসবুকে লগইন করল। ঈশিতা ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করেছে, অনলাইনেও আছে। সাকিব চ্যাট বক্স এ মেসেজ পাঠালো: ‘Hi Ishita’,  কিছুক্ষণ পরই ওপাশ থেকে উত্তর আসলো: ‘Hello Vaia’।


Comments

Popular posts from this blog

হ্যান্ডরাইটিং, ক্যালিগ্রাফি, লেটারিং, টাইপোগ্রাফি ও টাইপফেইস ডিজাইন

দেয়াল

ছুটি